সংস্কৃতির রুপছায়া

উৎসব মানবিক আবেগের আনন্দঘন এক সর্বজনীন বহিঃপ্রকাশ। এক অর্থে সভ্যতার শুরুর সঙ্গে উৎসবের যোগ নিবিড়। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গেই উৎসব সম্পর্কিত। আর এ প্রসঙ্গে ধরে নিতে হবে যে শুরুর সময়ে এই উৎসব ছিল ব্যক্তির- তার হৃদয় অনুভবের আনন্দ-উচ্ছল বর্ণাঢ্য প্রকাশ। মানুষ সংগীত, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র, অভিনয়, দেয়ালচিত্র অঙ্কন ইত্যাদির মাধ্যমে আপন সৃজনশীলতার যে প্রকাশ ঘটিয়েছিল, সেটি ছিল উৎসবের সূচনা। কালপরিক্রমায় তা ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে প্রসারিত হয়েছে, পরবর্তী সময় সমষ্টি থেকে গোত্রে, গোত্র থেকে জাতিতে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার পর কোনো কোনো উৎসব ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বজনীন হয়ে উঠেছে।
উৎসব মানুষের মিলনমেলা। এখানে অংশগ্রহণ করে সে প্রাত্যহিক জীবনের দুঃখ-কষ্ট কিংবা গৎবাঁধা জীবনের ঊর্ধ্বে অন্যরকম আস্বাদনের আনন্দ উপভোগ করতে চায়। এই আনন্দ তাকে দেয় ক্ষণিকের স্বস্তি এবং একই সঙ্গে তার চেতনায় সঞ্চারিত করে শুভবোধ এবং মঙ্গলচিন্তা। উৎসবের মূল সুর নষ্ট চিন্তার বাইরে সত্য, সুন্দর এবং শুভবোধের মধ্যে আপন চেতনাকে প্রসারিত করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'উৎসব' প্রবন্ধে বলেছেন, 'উৎসবের দিনে আমরা যে সত্যের নামে বৃহত্তর লোকে সম্মিলিত হই, তাহা আনন্দ, তাহা প্রেম। ... উৎসবের দিন সৌন্দর্যের দিন। এই দিনকে আমরা ফুল-পাতার দ্বারা সাজাই, দীপমালার দ্বারা উজ্জ্বল করি, সংগীতের দ্বারা মধুর করিয়া তুলি। এই রূপে মিলনের দ্বারা, প্রাচুর্যের দ্বারা, সৌন্দর্যের দ্বারা আমরা উৎসবের দিনকে বৎসরের সাধারণ দিনগুলির মুকুটমণি স্বরূপ করিয়া তুলি।'
বাংলাদেশের উৎসব বাঙালির জীবনেও মুকুটমণি স্বরূপ। এই উৎসবকে মোটাদাগে তিনটি বৈশিষ্ট্যে ভাগ করা যায়। যেমন- সাংস্কৃতিক উৎসব; জাতীয় দিবসের উৎসব এবং ধর্মীয় উৎসব। সাংস্কৃতিক উৎসবের মধ্যে পড়ে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন এবং দেশজুড়ে অসংখ্য লোকমেলা। জাতীয় দিবসের উৎসবগুলো হলো শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি। ধর্মীয় উৎসবে আছে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবেবরাত, মহররম, দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, বড়দিন, বৈশাখী পূর্ণিমা ইত্যাদি।
উৎসব তার বিশিষ্টতা এবং বহুমুখী চরিত্র অর্জন করেছে নানা কারণে। বিভিন্ন জাতিসত্তা তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য নিজস্ব উৎসব পালন করে। সেটা হতে পারে সামাজিক, হতে পারে ধর্মীয়। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ভেতর দিয়ে উৎসব ক্রমরূপান্তরে এগিয়েছে- কখনো সময় বদলে গেছে, কখনো উৎসবের আয়োজন বদলে গেছে। বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কালের বিবর্তনে সময়ের উপযোগী হওয়ার কারণেই এমনটি ঘটেছে।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির আদিতম উৎসব। এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ এনামুল হক বলেছেন, "খ্রিস্টাব্দ, হিজরি, অব্দ, শতাব্দ, বিক্রমাব্দ, বুদ্ধাব্দ অথচ বঙ্গাব্দ প্রভৃতি কোনো নির্দিষ্ট বছরের সঙ্গে নববর্ষের কোনো যোগ নেই, অর্থাৎ কোনো প্রকারের বৎসরের গণনার প্রারম্ভ থেকে কোনো দেশের অথবা জাতির 'নববর্ষ' শুরু হয়নি। এ হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসা একটা বাৎসরিক উৎসব। কোনো ধর্মের সাথেও নববর্ষের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশিষ্ট বৎসরগুলো যেমন পরে এসে এতে যুক্ত হয়েছে, বিশিষ্ট ধর্মও তেমনি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। প্রকৃতপক্ষে বয়সের তুলনায় 'অব্দই' বলুন আর ধর্মই বলুন নববর্ষের উৎসবের কাছে নেহাত সেদিনের খোকা, আধুনিক নববর্ষের উৎসবের মধ্যে আদিম নববর্ষের পরিবর্তিত রূপ লুকিয়ে আছে। তাই তার প্রাচীন অনুষ্ঠানাদিকে আধুনিক অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে খুঁজে বের করতে হবে।" ড. মুহম্মদ এনামুল হকের এই বক্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। আবহমান বাংলার উৎসবের এই প্রাচীন রূপ থেকেই আমাদের ধারণা করে নিতে হবে যে কৃষিভিত্তিক সমাজের জীবনব্যবস্থার ফসলকেন্দ্রিক উৎসব সামাজিক বড় আকারের উৎসবের সূচনা করে। শিকারভিত্তিক আদিম জীবনের উৎসব ছিল, গোত্রভিত্তিক, সর্বজনীন।
নববর্ষ এই দেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের যে গণভিত্তি তার শিকড় সুদূর অতীতে প্রোথিত। এই উৎসবের সংযোগ আমাদের অস্তিত্ব আর অনুভূতির সঙ্গে জড়িত- এটি আমাদের সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র।
সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ৯৬৩ হিজরি মোতাবেক ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। ২৯ বছর রাজত্ব করার পর তিনি পঞ্জিকা ও বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। হিজরি সন ও সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরকে যুক্ত করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। বলা হয়ে থাকে যে ফসল কাটার মৌসুমে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এই সন চালু করা হয়েছিল। হিজরি সন হলো চান্দ্রসন, চাঁদ দেখে গণনার ওপর এই সনের ভিত্তি। বাংলা সৌরসন। সৌরসনে দিনক্ষণ গণনা সহজ এবং এর একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি আছে। সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আমির ফাতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা মাসের নামগুলো নক্ষত্রের নাম থেকে নিয়ে সৌরমাসের দিন মিলিয়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এ ব্যাপারে ১৫৮৫ সনের ১০ মার্চ সম্রাটের নির্দেশনামা জারি হয়। তবে এর কার্যকারিতা দেখানো হয় ১৫৫৬ সনের ১১ মার্চ থেকে। কারণ ওই দিনটি ছিল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে বসার তারিখ। সেই থেকে শুরু।
এখন বাঙালি সংস্কৃতির একটি বৃহৎ এবং মৌল উপাদান বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব এবং বৈশাখী মেলা। এটি শুধু সংস্কৃতি নয়, এটি অর্থনীতিও অর্থাৎ উৎপাদন শক্তির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে বাংলা নববর্ষ। এভাবে লোকজীবনের সাংস্কৃতিক ধারাকে বাংলা সন দিয়েছে গতি, যে গতি এখন আমাদের জীবনে বিভিন্ন দিক থেকে হয়েছে তাৎপর্যমণ্ডিত।
বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নিজের শিকড় খোঁজার প্রেরণা। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের পিছিয়ে পড়া সময়কে অতিক্রম করতে চাইছে অস্তিত্বের জাগরণের মধ্য দিয়ে। এটা প্রমাণিত হয়েছে যে অস্তিত্বের জাগরণ ছাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্ভব নয়। দেশের উন্নয়নকে সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে পরিচালিত না করলে সে উন্নয়ন ব্যর্থ হতে বাধ্য- পরিণাম হয় ভয়াবহ। উন্নয়নের মেকি ডামাডোল প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ মানুষ। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের পণ্ডিত ও গবেষকরা ঐতিহ্যের আধুনিক বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছেন। কেবল সমাজতাত্তি্বক নয়, তার নৃতাত্তি্বক পর্যালোচনাও হচ্ছে। শুধু আবেগ দিয়ে নয়, ইতিহাসমুখী দৃষ্টি ও বিজ্ঞানমনস্কতাও এই বিচার-বিশ্লেষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ঐতিহ্যের কল্যাণধর্মী মানবিক চেতনা বর্তমান বিশ্বের মানুষের এক পরম সম্পদ।
ঋতু-বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বলা হয় এ দেশে অনুষ্ঠিত হয় ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। ঋতুকে আহবান করে বাঙালি পালন করে ঋতু উৎসব। 'বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'- ঋতুরাজ বসন্তকে এভাবে আহবান করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। বসন্তে প্রকৃতিতে আসে রঙের ছোঁয়া- শীতকালে ঝরে যাওয়া ডালে গজায় নতুন পত্র, যেন জীবনের নবীন প্রাণস্পন্দন। বসন্তকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয় উৎসবের। বসন্তের প্রথম দিন মেয়েরা হলুদ শাড়ি পরে, গাঁদা ফুলের মালা খোঁপায় জড়িয়ে নেমে আসে পথে। রঙে ভরে ওঠে শহরের রাস্তা। বেজে ওঠে সংগীতের সুর 'বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'। প্রাত্যহিকতার ঊর্ধ্বে মানুষের এক আশ্চর্য সম্মিলন ঘটে প্রকৃতির সঙ্গে। অজস ফুল মানুষকে দেয় অনাবিল আনন্দ। আর বাংলাদেশের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতায় জমে ওঠে উৎসব এবং দেশের অন্যান্য জায়গায়ও আয়োজিত হয় উৎসব।
শীত ঋতুর উৎসব পৌষমেলা। এই মেলা সূচনা হয় শান্তিনিকেতনে। আয়োজন করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মেলার উদ্বোধন হয় বঙ্গাব্দ ১২৩৬ সনের ১৮ পৌষ। তারপর থেকে ধীরে ধীরে এই মেলা জমে ওঠে। এখন পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে নানা মাত্রায় আয়োজিত হয় এই মেলা।
বাংলাদেশে বর্ষাবরণ উৎসবের আয়োজন করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। শহরজুড়ে সংগীতে, নৃত্যে এবং বর্ষার ফুলের সুবাসিত আমেজে প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে উৎসব প্রাঙ্গণ। এই সময়ে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় শহরে এবং গ্রামে আয়োজিত হয় নৌকাবাইচ। নদী এবং নৌকা বর্ষার প্রাণ।
বাংলার ঋতু হেমন্ত নবান্ন উৎসবের মাস। এক সময় এই উৎসবের প্রবল জোয়ার ছিল কৃষিভিত্তিক গ্রামবাংলায়। নতুন ধানের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠত গ্রামের কৃষক। পিঠে-পুলি বানানোর ধুম পড়ে যেত ঘরে ঘরে। নবান্নর দিন ধানকাটার বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত হিন্দু সমাজ। উৎসবের দিন সকালেই দই কিনে আনা হতো বাড়িতে। তারপর স্নান সেরে আগের দিন ধুয়ে রাখা কাঠা, কাস্তে, তিল, সিঁদুর নিয়ে নির্দিষ্ট জমিতে যেত ধানকাটতে। জমিতে সিঁদুর কাজলের তিনটি করে ফোঁটা এঁকে দিয়ে নতুন ধানের শিষ খুব আলতো করে ছিঁড়ে নেওয়া হতো, যেন ধানের শিষ ব্যথা না পায়। তারপর এই গুচ্ছ কাঠায় ভরে ঘরে ফেরা হতো। নতুন ধান যখন কাটা হতো সে সময় বাজতে থাকত শঙ্খ- নতুন ফসল তোলার আনন্দ ছড়িয়ে যেত সবখানে। ধানকাটার আগে গ্রামের কেউ সে সময়ের উৎপাদিত নতুন সবজি খেত না, নতুন চালের ভাতও নয়। কারণ পূর্বপুরুষকে নবান্নের নতুন অন্ন নিবেদন না করে নতুন চালের ভাত খাওয়া ছিল একদম নিষিদ্ধ।
পূর্বপুরুষকে শ্রদ্ধা নিবেদনের এই বিষয়টি সবাই মানত। অন্ন নিবেদনের পর্ব হয়ে গেলে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে নানা ধরনের খাবার পরিবেশন করা হতো। পহেলা অগ্রহায়ণ নির্ধারিত নবান্নের দিন। কিন্তু দেখা গেছে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক জীবনে কালের পরিক্রমায় এই উৎসব অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। গত বছর নবান্ন উৎসব দেখতে গিয়েছিলাম বগুড়া জেলার গণ্ডগ্রাম নামের গ্রামে। এখনো ওই অঞ্চলে নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। চলনবিলের উত্তর অংশ থেকে আদিনাজপুর পর্যন্ত পুরো উত্তরাঞ্চলে এই উৎসব এখনো টিকে আছে। অন্যদিকে অন্যান্য অঞ্চলে এই উৎসবের প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। মেলার আয়োজন বাংলাদেশের প্রাচীন উৎসব। প্রায় বলতে গেলে সারা বছরই বিভিন্ন জায়গায় মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। আর মেলা উপলক্ষে থাকে বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ও পণ্যসামগ্রীর সমাহার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশে পাঁচ হাজারের মতো মেলা আয়োজিত হয়ে থাকে। তবে এটা দেখা গেছে যে এসব মেলা আয়োজনের পেছনে একটি কারণ থাকে, অর্থাৎ সুস্পষ্ট লক্ষ্য মেলার আয়োজনকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। মেলা কখনো হয় ধর্মীয়, কখনো বিষয়ভিত্তিক- মেলার জায়গা নির্দিষ্ট থাকে ও মাস এবং তারিখও। যেমন বলা যায়, সুপ্রাচীন লাঙ্গলবন্দের মেলার উপলক্ষ চৈত্র মাসের অশোকাষ্টমীর স্নানযাত্রা। আবার সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের মেলাও অনেক পুরনো, এর উপলক্ষও ধর্মীয়। ভাদ্র মাসের শেষ তারিখে মনসা পূজা উপলক্ষে গুড়পুকুর থেকে ইটখোলা কামাননগর পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে মেলা বসে। আগে এই মেলা এক দিনই হতো, এখন হয় সাত দিন। এমন আরেকটি মেলা গোলাকান্দাইল মেলা। এটি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার একটি গ্রাম। কথিত আছে, এই গ্রামে দীর্ঘকাল আগে থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার হাট বসত। এই হাটের দিন প্রতিবছর মাঘ মাসের এক তারিখে মেলা বসত। চলত সাত দিন। এখনো বিরাট মেলা হয়, জমজমাট থাকে সাত দিনই। তবে কেউ জানে না, গোলাকান্দাইলের এই মেলা কবে থেকে শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বারুণী স্নান ও এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বারুণী মেলা বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত মেলা। গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দি গ্রামে সপ্তাহব্যাপী এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মতুয়া ধর্ম সম্প্রদায়ের এটি প্রধান উৎসব। এই দিন মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুর গোপালগঞ্জ জেলার আলফাডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ওড়াকান্দি ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। সে কারণে এই মেলার দিনটি মতুয়াদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। প্রতিবছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমার পূর্ববর্তী একাদশী তিথির বারুণী যোগের স্নান উপলক্ষে মেলা বসে। এই দিন হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন। তবে এই মেলার একটি অন্যতম দিক মতুয়া ভক্তদের মিছিল। অন্য কারো মেলায় মিছিল হয় না। এই মেলায় পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর দূর-দূরান্ত থেকে নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে মিছিল করে ওড়াকান্দি আসে। মিছিলে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। মিছিলে লাঠির মাথায় তিনকোনা আকারের লাল কাপড় বেঁধে বহন করা হয়। বাজনার তালে তালে মিছিল অগ্রসর হয়। এক সময় দেখা যায়, বাজনার তালে তালে মানুষ নাচতে নাচতে এগোচ্ছে।
বাঙালি মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার পর এই উৎসব আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়। ঈদের জামাত ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আহবান করে নতুন কাপড় পরে শিশু-কিশোরদের কলহাস্য মুখরিত করে তোলে চারদিক। ঈদের আগের দিন চাঁদ দেখার আনন্দ উৎসবের আনন্দের আমেজ ঘনিয়ে তোলে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে চাঁদ দেখার ঐতিহ্য পুরনো ঢাকায় বেশ আনুষ্ঠানিকতা পেত। মোগল সুবেদার ইসলাম খান শাসনভার নিয়ে ঢাকায় আসার পর ঈদের আনন্দ অন্য রকম করে ফেলেন। চাঁদ দেখার পর গোলন্দাজ বাহিনী কামান দাগিয়ে ঈদের ঘোষণা দিত। তখন থেকেই ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় মেলার আয়োজন করা হতো। ইতিহাসবিদ, গবেষকরা জানান, ১৮ শতক থেকে ঢাকায় ঈদমেলার প্রচলন লক্ষ করা যায়। ২০ শতকের প্রথমদিকে এই মেলা ঢাকার ঈদ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে। ইসলামপুর, সোয়ারিঘাট, লালবাগ, চকবাজার ইত্যাদি জায়গায় এসব মেলা বসত। নারী-পুরুষ-শিশু সবাই আসত মেলায়। আশরাফউজ্জামান 'ঢাকায় ঈদ' প্রসঙ্গে লিখেছেন, খেলাধুলারও আয়োজন হতো ঈদের দিন। ঘুড়ি ওড়ানো ছিল তখন সবচেয়ে শখের মেলা। নবাব-বাদশা থেকে মহল্লাবাসী পর্যন্ত মেতে উঠত ঘুড়ির খেলা নিয়ে। আকাশে কবুতর উড়িয়েও আনন্দ পেত অনেকে। ঈদের দিনে বুড়িগঙ্গায় নৌকাবাইচ হতো খুব ঘটা করে। ইসলামপুর আর চকবাজারে বসত ঈদের মেলা। নানা রকম পণ্য সম্ভার নিয়ে ব্যবসায়ীরা আসতেন দূর থেকে। সন্ধ্যায় বাতি দিয়ে সাজানো হতো ঢাকা শহর। এখনো ঈদের দিনে আলো দিয়ে সাজানো হয় শহর। হাজারীবাগের মাঠে তিন দিন মেলা চলে। এ সময় ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলারও আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। ইসলামপুরে রাস্তার দুই পাশে খাবারের দোকান বসে। হস্তশিল্পের সামগ্রীও পাওয়া যায়। তবে এটা সত্যি, নানা বিবরণ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায় দেখা যায় যে আগের দিনের ঈদ উৎসবের চেয়ে বর্তমানের ঈদ উৎসব অনেক ম্লান হয়ে গেছে।
দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের সবচেয়ে বড় উৎসব। দুর্গাপূজা শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয়। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে এই পূজা শুরু হয়। শেষ হয় দশমীতে। পূজার সঙ্গে সঙ্গে চলে উৎসবও। চমৎকার দেবী-প্রতিমা তৈরি হয়, পূজামণ্ডপ যেমন সৌন্দর্যের তেমনি আনন্দের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঋতুর দিক থেকে শরৎ অত্যন্ত মনোরম ঋতু। প্রকৃতিতে স্নিগ্ধ আমেজ বিরাজ করে। নতুন কাপড় পরা, মিষ্টান্ন বিনিময়, যাত্রা অভিনয়, নৃত্যগীতের আসর জমিয়ে তোলে উৎসবের মেজাজ। কটা দিন যেন বাতাসের বেগে উড়ে যায়। রেখে যায় দেবী-প্রতিমা বিসর্জনের বেদনা। বিজয়া দশমীতে ঘটে বিচ্ছেদের পালা। দেবী-প্রতিমাকে বিসর্জন দিতে হয় নদীতে, খালে কিংবা বিলে। এ উৎসবে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়। বিবাহিত মেয়েরা আমন্ত্রণ পায় বাবার বাড়িতে। ধর্মীয় অনুষঙ্গ এমন যে দেবী দুর্গাও এ সময়ে সন্তানদের নিয়ে কৈলাস থেকে বাবার বাড়িতে আসেন। তবে এ পূজার মূল বাণী, মানুষের মঙ্গল, অমঙ্গল দূর করা। যে দুর্গার প্রতিমা আমরা দেখি, তিনি অসুরবধকারিণী। ধর্মের এই মূল সুরটুকুই মানবজীবনের বড় দিক। কল্যাণের মঙ্গলের মধ্যেই তো নিহিত আছে বেঁচে থাকার অর্থ।
হিন্দু ধর্মের আরো অসংখ্য উৎসবের দিন আছে, এই ছোট পরিসরে তার সব উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তবে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠিত হয় ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাষ্টমীর দিন। এ দিন মিছিল হয়, এক সময় আয়োজিত হতো মেলা। ঢাকা শহরে জন্মাষ্টমীর মেলা বেশ বিখ্যাত ছিল। সাম্প্রদায়িক কারণে পাকিস্তান আমলের প্রথমদিকে এই মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অথচ এক সময় ৫০০ বছরের পুরনো এই ঢাকা নগরীর মানুষ ধর্মবর্ণ, গোত্র-নির্বিশেষে সব ধরনের উৎসবে আনন্দ করত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সৌহার্দ্য ছিল তাদের মধ্যে। হিন্দুদের জন্মাষ্টমী মিছিলে মুসলমানরা অংশ নিয়েছে। আবার মুসলমানদের ঈদ মিছিল কিংবা ঈদের মেলায় হিন্দুরাও আনন্দে উপস্থিত থেকেছে।
বাংলাদেশের জাতীয় উৎসবগুলো পালিত হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস উদ্‌যাপিত হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। সামাজিক সংগঠনগুলো এই দিবস দুটিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বাংলাদেশের একটি অন্যতম অনুষ্ঠান শহীদ দিবস।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে জীবন দিয়েছিল বাঙালি। একটি শোক দিবস কিভাবে উৎসবের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপন তার প্রমাণ। এ দিবসকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বইমেলার আয়োজন করা হয়। মাসব্যাপী বইমেলার আয়োজন পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। মেলাজুড়ে থাকে শুধুই বাংলাদেশের বই। এ মাস বাঙালিকে উজ্জীবিত করে আপন শিকড়ে ফিরে যাওয়ার প্রেরণায়।
পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির নানা ধরনের উৎসবের দিন থাকে, যেটা সবাই মিলে পালন করে। উৎসব একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম দিক। একে কেন্দ্র করে প্রবর্তিত হয় জাতির নাড়ির স্পন্দন- জাতির শেকড়ের সন্ধান এইসব উৎসবের ভেতরে মূর্ত হয়ে থাকে। উৎসবের রূপান্তর ঘটে; কিন্তু টিকে তার নির্যাসটুকু- সেই নির্যাস আবার নতুন সময়ে নতুন আদলে ফিরে আসে মানুষের মাঝে।
উৎসব মানুষের মহামিলনকে মূর্ত করে দেয় মানবিকতার ছোঁয়ায়। উৎসব শুধুই আনুষ্ঠানিকতা নয়, উৎসব আবেগের, উৎসব পরিচয়ের। বাঙালির জীবনে উৎসব শুধু সামাজিকতা কিংবা আনুষ্ঠানিকতা নয়। এখানে কোনো কোনো উৎসব শোক এবং শক্তির মিলনক্ষেত্র, কোনো কোনো উৎসব অসাম্প্রদায়িক মানবপ্রীতির নিদর্শন। অন্যদিকে এসব উৎসবের বৈচিত্র্য, বিশিষ্টতা এবং এর নান্দনিক মাধুর্য বাঙালিকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছে

ConversionConversion EmoticonEmoticon

:)
:(
=(
^_^
:D
=D
=)D
|o|
@@,
;)
:-bd
:-d
:p
:ng